বাংলাদেশের সর্বপ্রথম সার্চইঞ্জিন তৈরি করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী। 'পিপীলিকা' (www.pipilika.com) নামক এই সার্চইঞ্জিনটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তথ্য অনুসন্ধান করতে পারবে। গ্রামীণ ফোন আইটি বিভাগের সহযোগিতায় পিপীলিকার প্রকল্প পরিচালনায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং মুখ্য গবেষক ও টিম লিডার হিসেবে কাজ করেছেন মো. রুহুল আমীন সজিব। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক এবং টিম লিডার রুহুল আমীন সজিব জানান, আপাতত এটি বেটা ভার্সন আকারে ছাড়া হয়েছে। এতে যে কেউ পরামর্শ দিতে পারেন। শাবিপ্রবির ১১ জন ডেভেলপার মিলে এটি তৈরি করেছেন। এ ছাড়াও ৩০ জন শিক্ষার্থীর থিসিসের ওপর ভিত্তি করে এর প্রজেক্ট তৈরি করা হয়েছে। নিজের ভাষায় তথ্য খোঁজার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন। বাংলায় তথ্য ও বাংলাদেশি বিষয় খোঁজার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশি দুটি সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে ইন্টারনেটে। ‘বাংলাদেশকে খোঁজো’ স্লোগান নিয়ে এপ্রিলে চালু হয়েছে বাংলাদেশি সার্চ ইঞ্জিন চরকি (www.chorki.com) । এর আগে ২০১৩ সালে চালু হয় পিপীলিকা ডটকম (www.pipilika.com) নামের আরেকটি সার্চ ইঞ্জিন। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগলেও আছে বাংলা ভাষায় তথ্য খোঁজার সুবিধা। গুগলের মতো বড় ওয়েবসাইটের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কি দেশি সার্চ ইঞ্জিনগুলো টিকতে পারবে? চীনে আবার চিত্র আলাদা। সেখানে কিন্তু নিজেদের ভাষার সার্চ ইঞ্জিন ‘বাইদু’-এর জনপ্রিয়তা বেশি। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের নতুন সার্চ ইঞ্জিন চরকি এগিয়ে যেতে চাইছে।

চরকি
চরকি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সার্চ ইঞ্জিন। চালু হয়েছে গত ২০ এপ্রিল। এতে আছে বাংলা ভাষায় আট লাখেরও বেশি তথ্য। বর্তমানে এর পরীক্ষামূলক সংস্করণ (বেটা) চলছে। ওয়েব, পণ্য ও সংবাদ বিভাগে এখানে নির্দিষ্টভাবে তথ্য খোঁজা যাবে। খাবার, চাকরি ও ক্রিকেট নামে খুব দ্রুতই আরও দুটি বিভাগ আসছে বলে জানান চরকির সহপ্রতিষ্ঠাতা রাশেদ মোসলেম। তিনি জানান, সার্চ ইঞ্জিন চরকির পরিচালনায় আছে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান চরকি লিমিটেড।
চরকিতে তথ্য সংযোজিত হচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার সংবাদ, বিভিন্ন বাংলা ব্লগ, বাংলা উইকিপিডিয়া, জাতীয় ই-তথ্যকোষ ও নানা রকম উৎস থেকে। চরকি কাজ শুরু করে ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে। শুরুতে এই কাজে যুক্ত ছিলেন পাঁচজন, এখন কাজ করছেন ২৩ জন। সার্চ ইঞ্জিন তৈরির কারিগরি কাজগুলো করেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী ইমতিয়াজ শাকিল এবং প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা নাজমুস সাকিব। পিএইচপি, হ্যাডপ, সোলার প্রভৃতি সফটওয়্যার ব্যবহার করে সম্পূর্ণ নিজেদের উপযোগী করেই নির্মাণ করা হয়েছে সার্চ ইঞ্জিনটি।
নাজমুস সাকিব জানান, চরকির যাত্রা শুরু হয়েছে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। যেসব তথ্য, পণ্য ও সেবার সঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টতা আছে, সেসবই মিলবে অনুসন্ধানে। নির্মাতারা জানিয়েছেন, চরকি বাংলাদেশের ব্যবসায়িক সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। বর্তমানে চরকিতে তিন লাখেরও বেশি পণ্যের বিস্তারিত তথ্য দেখা যাচ্ছে।
রাশেদ মোসলেম বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়তই নানা ধরনের বিষয়বস্তু যোগ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। সবাই তথ্যের জন্য সার্চ ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরশীল। চরকি মানুষের তথ্যপ্রাপ্তিকে আরও সহজ করবে। দেশীয় পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছাবে, সবাই জানবে। কারণ, বর্তমান সময়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ ও সফল মাধ্যমই হলো সার্চ ইঞ্জিন। আমরা এখনো তথ্য সংগ্রহ করছি, যোগ করছি যা চলতে থাকবে।’
চরকির প্রতিষ্ঠাতারা জানালেন, সার্চ ইঞ্জিন চরকির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখনো ততটা শক্তিশালী নয়। শক্তিশালী হলে অনুসন্ধানের ধরন বুঝে ফলাফল দেখানো সম্ভব। তবে এটা হবে, কাজ চলছে। নির্মাতারা বলছেন, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে চরকি ব্যবহারকারীর চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো খোঁজের ফলাফল দেখাতে পারবে। শুধু বাংলাদেশের তথ্যসংবলিত সার্চ ইঞ্জিনটি ব্যবহার করা যাবে বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষাতেই।

পিপীলিকা
২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হয় বাংলা ভাষার প্রথম সার্চ ইঞ্জিন পিপীলিকা। এর নিয়মিত হালনাগাদ চোখে পড়ে না। এখানে ঢুকে কোনো কিছু খুঁজলে সাধারণত নির্দিষ্ট বিষয়ের কোনো তথ্য মেলে, অন্য কিছু দেখা যায় না। তবে এতে সাম্প্রতিক সংবাদগুলো পাওয়া যায়। অবাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চালু হওয়া পিপীলিকা শুরুতে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। নিয়মিত উন্নয়ন না হওয়ায় পিপীলিকা এখন সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে খুব একটা ব্যবহৃত হচ্ছে না।
বিষয় যখন দেশি সার্চ ইঞ্জিন
দেশি সার্চ ইঞ্জিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আনন্দ কম্পিউটারসের প্রধান নির্বাহী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। সহজে তথ্য পাওয়ার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম এখন ইন্টারনেট। সেখানে নিজ ভাষায় তথ্য খুঁজতে চাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এটা আসলেই পরিমিত চিন্তা। তবে, শুধু সার্চ ইঞ্জিন হলেই তো হবে না, প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু, তথ্য থাকতে হবে। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ও বাংলাদেশিদের জন্য নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিনের কোনো বিকল্প নেই। দেশীয় প্রথম সার্চ ইঞ্জিন “পিপীলিকা” থাকলেও সেটি প্রাথমিক অবস্থায় আছে। চরকি আসছে নতুন করে। তাদের জন্য শুভকামনা।’
বেসিসের সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘দেশীয় সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে চরকি দেশীয় কনটেন্ট নিয়ে কাজ করবে, এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। অনেক বড় প্রকল্প। তবে, চালু রাখাটা কঠিন হবে। ইন্টারনেটে আমাদের স্থানীয় ভাষার বিষয়বস্তু, তথ্যের যথেষ্ট অভাব আছে, সেটা পূরণ হলে তো ভালোই হয়। গুগল যদিও আমাদের তথ্য দিচ্ছে, তারপরও গুগলের সব তথ্য সঠিক নাও হতে পারে। উন্নত প্রযুক্তি, নিবেদিত শ্রম, প্রচারণা আর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যই পারে চরকির সফলতা নিশ্চিত করতে।’
0 Comments